প্রকৃতিতে হিম ঘ্রাণ
আসহাব আরমান
হেমন্ত এলেই প্রকৃতি যেন নিজের ছন্দ বদলে ফেলে। আকাশে ম্লান রঙ, বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা, আর চারদিকে একধরনের নীরব প্রত্যাশা। কার্তিকের সন্ধ্যা নামতেই সেই পরিচিত নিঃশব্দ হিম শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। ভোর পর্যন্ত মাটি, ঘাস ও পাতার উপর জমতে থাকে অদৃশ্য স্বচ্ছ এক মায়া—শিশির।
শিশিরের এই আগমনীকে কেউ দেখেনি, তবুও তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় প্রতিটি প্রভাতে। হেমন্তের সকাল যেন নিজস্ব আলোয় সাজানো এক মঞ্চ। প্রথম সূর্যের কমলা রোদ যখন নরম ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর ওপর পড়ে, তখন তারা যেন ছোট ছোট তারার মতো ঝলমল করে ওঠে। কেউ নিজের চোখে দেখতে ভুলে গেলে প্রকৃতি নিজেই মনে করিয়ে দেয়, তার প্রতিটি সকালই আসলে এক নতুন আলোর উৎসব।
ঘাসের উপর সাদা রূপালি চাদর পেতে থাকা এই শিশির কখনো মাটির ঘ্রাণকে আরও কোমল করে তুলে। কখনো পাতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা ঘুমন্ত মাকড়সার জালে ঝুলে থাকে মুক্তোর মতো। ভোরের আলো ছুঁতেই সেই জাল ঝলসে ওঠে, আর মনে হয় ঊর্ণনাভ যেন প্রকৃতির গয়নার বাক্স খুলে দিয়েছে আজ।
অথচ এই সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। হাত বাড়ালেই শিশিরবিন্দু গলে যায়—আঙুলের উষ্ণতায় মিলিয়ে যায়। তবুও সেই ক্ষণটুকুই প্রকৃতির মায়ার গভীরতম পরিচয়। এক মুহূর্তের জন্য হলেও মনে হয়, প্রকৃতি নিজের কোমল স্পর্শ দিয়ে আমাদের জাগিয়ে তুলছে।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে; / বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা, / কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।’ নগরের ভেতরে হয়তো শীত একটু দেরিতেই আসে। উঁচু ভবন আর কোলাহলের মাঝে রাতগুলো এখনো ততটা শীতল নয়। তবুও ভোরের কুয়াশায় ঘেরা বাতাসে যখন শিশিরবিন্দুর স্পর্শ পাওয়া যায়, তখনই নিশ্চিত হওয়া যায়—শীত দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
হেমন্তের এই হিম হিম ঘ্রাণ আসলে শীতের প্রথম আমন্ত্রণপত্র। প্রতিটি প্রভাতেই প্রকৃতি সেই আমন্ত্রণ নতুন করে পাঠায়—শিশিরের নরম চাদরে, কুয়াশার কোমল পর্দায়, আর অচেনা ঘ্রাণ মাখা শীতল বাতাসে।










